নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে কাজ করার লক্ষ্যে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মহিলা পরিষদের মতবিনিময় সভা

বুধবার, ডিসেম্বর ৪, ২০১৯,৬:২১ পূর্বাহ্ণ
0
116

[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর পক্ষ থেকে সকলকে জানাই শুভেচ্ছাসহ উষ্ণ অভিনন্দন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিশ্ব নারী আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে সহিংসতামুক্ত, নারীর প্রতি সংবেদনশীল, সমতাপূর্ণ, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ৪৯ বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ৩৯ বছর যাবৎ এই সংগঠন নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও নির্মাণের লক্ষ্যে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করে আসছে। অব্যাহতভাবে নারী ও কন্যা নির্যাতন বিরোধী, নারীর প্রতি সংবেদনশীল পারিবারিক ও জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই লক্ষ্যে তরুণ ও পুরুষ সমাজকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহন করছে।

নারী ও কন্যা নির্যাতন বিরোধী সংগ্রাম মানুষের অধিকার রক্ষা তথা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতিসংঘ ও বিশ্ব নারী আন্দোলনের ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে একাত্ম হয়ে- ‘ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ-আসুন এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও (২৫ শে নভেম্বর- ১০ই ডিসেম্বর) ২০১৯ পক্ষকালব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহন করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক সূচকে অগ্রসরমান দেশ। একুশ শতকের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদে নারীর অতি শীর্ষে অবস্থান; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর দৃশ্যমান অগ্রসর ভূমিকা এক ইতিবাচক বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরে। কিন্তু তার পাশেই নারীর মানবাধিকার লংঘন এবং নারীর প্রতি সহিংস আচরণের প্রতিদিনের ঘটনাসমূহ এই উজ্জ্বল চিত্রকে ম্লান করে দিচ্ছে। এদেশের কোটি কোটি নারী যেমন অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে, অনুন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে তেমনি নারীর প্রতি সকল ধরণের সহিংস আচরণ বিশেষ করে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের (ঘরে, যানবাহন, রাস্তাঘাট, পথে-প্রান্তরে, অফিসে, কর্মস্থলে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে) ঘটনা ঘটছে তা অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ স্বরূপ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত ১৪ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার (পেপার ক্লিপিং) তথ্যের ভিত্তিতে জানুযারি – অক্টোবর, ২০১৯ পর্যন্ত এই সময়কালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ মোট ৩৯০৮ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৭৫ জন তন্মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ২০১ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২২৫ জনকে। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৮৪ জন তন্মধ্যে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা ১৩ জন। তথ্যসূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তর, জনকন্ঠ, ভোরের কাগজ, মানবজমিন, ইনকিলাব, কালের কণ্ঠ, The Independent, The Daily Star, New Age, The Daily Observer|

এচিত্র নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতি নারী ও কন্যার অধিকার তো দূরের কথা তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। অসংখ্য সংগঠক, কর্মী, সমাজের বিবেকমান মানুষ এক আত্মজিজ্ঞাসা ও প্রশ্নের সম্মুখীন। নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমরা বিবেকের দংশন ও মানবিক দায়বোধ থেকে নীতিনির্ধারক, সমাজকর্মী, সচেতন নাগরিক সমাজ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের কাছে প্রশ্ন করতে চাই- কেন এই ধর্ষণ, কেন শিশু ধর্ষণ এমন উদ্বেগজনক সংখ্যায়, মাত্রায় ও অধিকতর পাশবিক পদ্ধতিতে সংঘটিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ও কারণসমূহ চিহ্নিত করার জন্যই আজকের এই মতবিনিময় সভা। আপনারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই লক্ষ্যে মতামত প্রদান করবেন এবং নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবেন।

নারী বা কন্যার প্রতি ধর্ষণ শুধু নারী নির্যাতনের বিষয় নয়, সমগ্র রাষ্ট্রের অর্জিত মানবিক মূল্যবোধের অপমান। ধর্ষণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যুদ্ধঅপরাধীদের বিচারের সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারিক কার্যক্রমে ধর্ষণ মানবতার বিরোধী অপরাধ নীতি গ্রহন করে অগ্রসর হয়েছে। ধর্ষণের মতো অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণকারীর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী ও কন্যার প্রতি যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ সব ধরণের নিষ্ঠুর ও সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা, প্রতিকারের কাজসহ নির্মাণের কাজ করে চলেছে। দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বিশ্বাস করি যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলের জন্য সমন্বিত বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহন করতে হবে। সাথে সাথে নারী নির্যাতনের মূল কারণগুলো দূরীকরণে কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা গ্রহন নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত ধারাবাহিক ভূমিকা।

বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শ্রেনী, বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থানের তারতম্য থাকলেও সে যে নারী এটাই তার প্রধান পরিচয় এবং এ কারণে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চার বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহানকে যৌন হয়রানির শিকার হওয়াসহ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। রূপা গণপরিবহণে কর্মস্থলে আসার পথে বাস ড্রাইভার ও কন্ট্রাক্টর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মী মিতুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীও শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়, মা-মেয়ে এক সঙ্গে ছেলের বয়সী তরুণ যুবকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ঐ সমস্ত ঘটনার প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এগিয়ে না আসলে ধর্ষণকারী ছাড় পেয়ে যাবে। যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে আওয়াজ তুলতে হবে। সমন্বিতভাবে ধর্ষণকারীকে রুখতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে নারী নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ ধরণ হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। নারী নির্যাতনের ঘটনায় ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। এর বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলন এখন যুগের দাবি।

নারী নির্যাতনের মূল কারণ যদি আমরা চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে দেখি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর অধ:স্তন অবস্থান ও নারীর ব্যক্তি অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্যপূর্ন অবস্থান। এসবের পেছনে রয়েছে পুরুষতন্ত্র। সমাজ দ্বারা সৃষ্ট জেন্ডার ধারণার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। সন্তান জন্মের পর শিশুকে সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে নারী ও পুরুষ হিসেবে তৈরি করা হয়। এভাবেই খন্ডিত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তানেরা।

১৯৯৩ সালের জাতিসংঘের নারী নির্যাতন বিষয়ক ঘোষণায় বলা হয়েছে- ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লংঙ্ঘন’। সেখানে বলা হয়েছে নারীর অধিকারগুলো হবে জীবনের অধিকার, সমতার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সম-নিরাপত্তার অধিকার, সব ধরণের সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকার অধিকার, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সেবা লাভের অধিকার, ন্যায্য ও অনুকূল কর্মপরিবেশের অধিকার। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও মানবাধিকার দিবস ২০১৯ পালনে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত প্রতিপাদ্য হচ্ছে ধর্ষণ এর বিরুদ্ধে সকলে মিলে দেশে দেশে রুখে দাঁড়াতে হবে। এক্ষেত্রে যার যার দেশেীয় প্রেক্ষিত থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

এদেশে নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য আইন হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। একজন নারী যখন ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হয় তাকেই প্রমাণ করতে হয় সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীকে দ্বি-আঙ্গুলী পরীক্ষার মতো ভয়াবহ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ বিষয়ে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে দ্বি-আঙ্গুলী পরীক্ষা বা টু ফিঙ্গার টেষ্ট এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলায় গত ১২ই এপ্রিল ২০১৮ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ রায় প্রদান করেন। যাতে মাননীয় বিচারকবৃন্দ ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী পরীক্ষার ক্ষেত্রে দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা বা টু ফিঙ্গার টেষ্ট অবৈধ ঘোষণা করে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এই রায় বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যান মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা প্রদান করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারকবৃন্দ। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যান মন্ত্রণালয় এবিষয়ে নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিপত্র জারি করেছে। এক্ষেত্রে ধর্ষণের ক্ষেত্রে মেডিকেল পরীক্ষা সকল কিছু বিবেচনায় নিয়ে পরিচালনা করতে হবে। এই রায় বাস্তবায়নের জন্য মেডিকো-লিগ্যাল ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে যার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যান মন্ত্রণালয়কে পালনসহ মনিটরিং করতে হবে।

ধর্ষণের শিকার নারী যখন পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যায় তখন কখনো কখনো থানা মামলা গ্রহন না করাসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয় যা ন্যায়বিচার থেকে তাকে বঞ্চিত করে। এ বিষয়েও নারী ও মানবাধিকার সংগঠন জনস্বার্থে মামলা দায়ের করলে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারকবৃন্দ ধর্ষণের ও সহিংসতার শিকার নারীর বিচারপ্রাপ্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করেছেন। এই রায় দুটি বাস্তবায়নের জন্য মহামান্য আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রয়োগ এর জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করতে হবে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সংস্কার করা হয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তরকারী রায়ে জানিয়েছেন যে ধর্ষণের শিকার নারীর সাক্ষ্যই আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট। বিচারপতি অরিজিত পামারাত ও এস এইচ দাপাদিয়া সমন্বিত দ্বৈত বেঞ্চ রায়ে উল্লেখ করেছেন ধর্ষণের শিকার নারীর সাক্ষ্য চিকিৎসকের রিপোর্টসহ অন্যান্য সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। ধর্ষণের শিকার নারীর পরীক্ষাকারী চিকিৎসক যদি ধর্ষণের আলামত নাও পান তারপরও ধর্ষণের শিকার নারীর সাক্ষ্য অবিশ্বাস করার কোন ভিত্তি নেই। মামলার পারিপার্শি¦ক সাক্ষ্যপ্রমাণে বিষয়টি যদি ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার সাক্ষ্য মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আদালতের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা উচিত নয়। দূর্বল পুলিশী তদন্ত ও সাক্ষ্যের দূর্বলতার কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ ধর্ষক ছাড়া পেয়ে যায়। বাংলাদেশে এই আইনটি দ্রুত সংস্কার ও নারীর মানবাধিকারের পক্ষে হওয়া জরুরী প্রয়োজন। আইনের দর্শনের ভেতরেই যদি সূক্ষ্মভাবে নির্যাতনের কথা থাকে তাহলে বাস্তবে নির্যাতন প্রতিরোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা কোনভাবেই হতে পারে না।

১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত নারীর প্রতি বিরাজমান সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) সংক্রান্ত ১৯ নং সাধারণ সুপারিশে বলা হয়েছিল নারীর প্রতি বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং নারীর মানবাধিকার লংঘন পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। বিশ্বের দেশে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ২০১৭’র জুলাই মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত ৩৫ নং সুপারিশে নারীর প্রতি সহিংসতাকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নারীর প্রতি সহিংসতা। সমাজের গভীরে বিরাজমান রীতি-নীতি, প্রথা, ক্ষতিকর চর্চার ফলে শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে যে কোন বয়সের, যে কোন অবস্থা-অবস্থানের নারী এবং কন্যা ভয়াবহ মাত্রার সহিংসতার শিকার। ৩৫ নং সুপারিশে এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সাধারণ দায়বদ্ধতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিশ্ব যাত্রা করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সমতাপূর্ণ পৃথিবী গড়ার দিকে। বাংলাদেশও এই যাত্রার অংশীদার। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫নং লক্ষ্য “জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন”। কিন্তু নারীরা যৌন-নিপীড়ন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নানা ধরণের ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হচ্ছে যা কিনা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী ২০২০ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য বেইজিং +২৫ এর অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারকে বাংলাদেশের পক্ষে নারীর অবস্থা বিষয়ক প্রতিবেদন পেশ করতে হবে।

বেইজিং +২৫ পূর্তিতে ম্যাপিং করতে হবে নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, কি চ্যালেঞ্জ আছে এবং তা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকার কি কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করেছে। এবিষয়গুলো পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করতে হবে, ভবিষ্যৎ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে যা কিনা একটি নির্যাতনমুক্ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে।

সুপারিশঃ
১. প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।
২. নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনসমূহের বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে মনিটরিং এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন সংস্কার করে সকলক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হবে।

৪. নির্যাতনের শিকার নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করতে হবে।
ক) প্রচলিত আইন পরিবর্তন করে ধর্ষণকারীকেই সে ধর্ষণ করে নাই এ বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে মর্মে বিধান আইনে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
খ) নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার মামলার সাক্ষীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
গ) বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।

৫. নিরাপদ অভিবাসনসহ দেশে ও বিদেশে নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৬. নারীর মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের প্রদানকৃত রায় ও নির্দেশনাসমূহের ব্যাপক প্রচার ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। যেমন-
ক) উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন নিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনামূলক রায়।
খ) ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়।
গ) মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ঘটনাস্থলকে মূখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোন বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষনিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধকরণ।

৭. যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণসহ সকল প্রকার সহিংসতার শিকার নারীর প্রতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সংবেদনশীল হয়ে তার পাশে সকল ধরনের সহায়তা নিয়ে দাড়াতে হবে।
৮. নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ রাখতে হবে।
৯. সংবিধানে ঘোষিত সমতার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে অধিকতর কার্যকর, দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পৃথক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করতে হবে।
১২. নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ছাত্র, তরুণ, যুবদের সম্পৃক্ত করে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বিঃদ্রঃ মানব সংবাদ সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করুন। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে