[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]
বর্ষ পরিক্রমায় যুগের কঠিন কালো পথ ধরে ৬৮ বছর পর আবার ঘুরে এসেছে সেই বাহান্নর ২১ শে ফেব্রুয়ারী। সেই রক্ত রাঙা একুশ। বাংলার আকাশ বাতাস আজ আবার মুখরিত হলো সেই অমর একুশের শুভাগমনী সুরে। এই সেই অবিস্মরনীয় ইতিহাসখ্যাত এক দিবস, যে দিবসে মায়ের ভাষাকে তার যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে আজ থেকে ৬৮ বছর পূর্বে এমনি এক সোনালী দিনের প্রভাতি পাখির কল-কাকলী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বাংলার শত-শত নর-নারীর আহত করুন আর্তনাদে। সবুজ কচি ঘাসের উপর পতিত ভোড়ের শিশিরের শুভ্র বুক রঞ্জিত হয়েছিল মায়ের কোল থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাণপ্রিয় পুত্রের বুকের তাজা রক্তে। বাংলার ভূতল কেঁপে উঠেছিল শত-শত মা, ভাই-বোনদের লৌহ কঠিন জীবন-মরণ শপথের সিংহ গর্জনে। তাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ উন্মেষের ইতিহাসে ২১ একটি সংগ্রামী শপথ, একটি বিরাট প্রাণসত্ত্বার চেতনা। আর এজন্যই ২১ শে ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় জীবনে একটি জয়-জয়ন্তীর উৎসব। ১৯৫২ সালের রক্ত শপথের এই দিনটি ছিল আমাদের বিপ্লবী চেতনার এক প্রচন্ড বহিঃপ্রকাশ, এক বিপ্লবী মহামন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার মহাসংকেত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মূলত: একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও সেটা ছিল বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের উৎস। আর সেই সংগ্রামের উৎস ধরে ১৯ টি বছরের রক্তের পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে তার সমাপ্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এক স্বাধীন, সার্বভৌম নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বার্থক হলো একুশে ফেব্রুয়ারীর স্বপ্ন।
একুশের স্বপ্ন সফল হলেও তার সমস্ত কাজ শেষ হয়নি আজও। আজকের এই বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে জীবন উৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর শহীদরা যে রক্ত দিয়েছে তার মূল্য অপরীসীম। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি সত্যি পেরেছি তাদের প্রতি আমাদের হৃদয়ের প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে? আমরা কি পেরেছি ৫২’র সেই ফেব্রুয়ারীতে বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের মহান আতœত্যাগের মহান আদর্শকে বাস্তবে রুপদান করতে? ফেব্রুয়ারীর ১ তারিখ হতে যে আয়োজন, এত যে অধীর প্রতীক্ষা, ২১শের সকাল থেকে আমরা অসংখ্য অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহন করি, সে কি প্রকৃতই বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য? সারাটি বছর আমরা তৎপর হই নিজেকে একজন পাশ্চাত্য দেশীয়র মত সাজাতে। আসনে ভূষণে, বিকৃত চাল-চলনে আমরা সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। কথায় কথায় ইংরেজী উচ্চারণে আত্মপ্রশান্তিতে নিজেই মুগ্ধ হই, কোন বিদেশীর সামনে নিজেকে বাঙালী ভাবতেও যেন নিজের জন্মটাকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়, লজ্জা পাই। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘ট্যাগোর’ বলে নিজের বিদ্যার প্রশস্ততা জাহির করি বন্ধুমহলে। সারা বছরের প্রতিটি মুহূর্তে একটি ভাষা তথা অনেক রক্তে ,অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত মহান বাংলা ভাষার ঐতিহ্য আর বাঙালী সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটাতে আমরা দ্বিধাবোধ করিনা। কিন্তু এই একটা দিন ২১শে ফেব্রুয়ারীতে আমরা সবাই হয়ে যাই বাঙালী। এই দিনে ২১শে স্মরণিকা বের না করলে দেশবাসী/ বিশ্ববাসী কি বলবে ? কাজেই বাহ্যিক শ্রদ্ধার আবরণ নিয়ে যেন আমরা স্মরণিকা বের করি।
একুশের ভোরে সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরে শোকচিহ্ন হিসেবে এক টুকরো কালো কাপড় লাগিয়ে নগ্ন পায়ে মৌন মিছিল করে শহীদ মিনারে গুটি কতক ফুল মালা দিয়ে আর প্রভাতফেরী করে আমরা আমাদের দায়িত্ব সম্পন্ন হলো মনে করি। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারীর দায়িত্ব কি শুধু এই? মনে হচ্ছে ২১শে ফেব্রুয়ারী যেন একটা নিছক আচার অনুষ্ঠানের দিন। আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব-কতর্ব্য থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। তাই আজ ২০২০’এর ফেব্রুয়ারীতে আমাদেরকে ভাবতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে বিগত ৬৮ বছরে আমরা মাতৃভাষার জন্য কি করতে পেরেছি, কি করতে চেষ্টা করেছি? ক’জন আমরা মাতৃভাষার উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হয়েছি? আসলে আমরা ইংরেজী শিখবোনা বলে পণ করেনি কিন্তু বাংলা শিখবো বলেও সেরকম কোন দৃপ্ত শপথ নেইনি। অথচ বাংলা শিখতে হবে, জানতে হবে। বাংলা ভাষার প্রীতি মানেই অন্য ভাষার প্রতি অবজ্ঞা নয়। অন্য ভাষার প্রতি অবজ্ঞার মনোভাব যদি থাকে তাহলে জ্ঞানের রাজ্যে ,প্রযুক্তির জগতে আমাদের প্রবেশাধিকার কমে আসতে বাধ্য হবে।
অপরদিকে দুঃখ হয়, লজ্জা হয় যখন দেখি দেশের নামকরা শীর্ষস্থানীয় কোন খবরের কাগজ এবং টিভি চ্যানেলসমূহ বহুজাতিক বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ভাষা সংগ্রামের বিজয়ের মহিমান্বিত ফেব্রুয়ারী মাসের ১ম দিন হতে শেষ দিন পর্যন্ত মাসব্যাপী শুদ্ধ বাংলা বানান জানানো বা শেখানোর পরিবর্তে মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের “ইংরেজী শব্দের বানান জানার প্রতিযোগিতার” আয়োজন করে। ঐ দিকে আবার ভাষা সংগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী দেশের পুরনো ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক পত্রিকা সমূহে এ খবরের শিরোনাম হয়। শুধু তাই নয় খুব কষ্ট হয় যখন আরও দেখি ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে আয়োজিত টকশো/ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে ভুল উচ্চরণে/কথায় এবং টিভি পর্দায় প্রদর্শিত আলোচকের নামের পরিচয়ে লেখা হয় বিশিষ্ট ভাষাবিদ/ ভাষা সৈনিকের স্থলে “বিশিষ্ট” শব্দের বানান “বিশিষ্ট্য” শব্দ লেখা হয়।
এভাবে চর্তুদিকে চলছে ভুল বাংলা বানান আর একই শব্দের/ বানানের বহুরূপে লেখার অনাকাংখিত মহোৎসব, যা দেখে খুব কষ্ট হয়। কি বিচিত্র সেলুকাস এই দেশ! মনে পড়ে যায় সেই নির্মম লজ্জার ‘এপ্রিল ফুল’ দিনটির কথা। অথচ একুশ আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, মনে করিয়ে দেয় ভাষার জন্য ত্যাগের দিন হিসেবে। এই দিনে ভাষা সংগ্রামের শহীদরা বুকের রক্ত দিয়ে যে ত্যাগ স্বীকার করে গিয়েছেন তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আমাদের শপথ নেওয়া উচিত “বাংলা ভাষার জন্য সকলকে যর্থাথ কিছু করতে হবে”। আর এ জন্য শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলা, অভিন্ন বাংলা বানান আর শব্দ ব্যবহারে হতে হবে আন্তরিক এবং দায়িত্বশীল। এক ও অভিন্ন বাংলা বানান ব্যবহারে জারী করতে হবে কঠোর রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা এবং গড়ে তুলতে হবে জোড়ালো সামাজিক আন্দোলন।
ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যারা বাংলাকে ভালবেসে, শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের প্রতিটি পণ্য/প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছেন এক অপূর্ব বাংলা শব্দের অলংকারে। সবশেষে আজকের ২০২০-এর অমর ২১শের সংগ্রামী দিনে আমাদের শপথ হোক এক ও অভিন্ন বাংলা বর্ণে, বাংলা শব্দ পড়তে চাই, লিখতে চাই। আর কোন বিকৃতি নয়, নয় কোন দ্বিধা-দন্দ্ব। প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে তার যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করতে যেয়ে যে আদর্শের জন্য বীর ভাষা সৈনিকেরা আতœহুতি দিয়েছিলেন, সেই আদর্শকে ,সেই মূল্যবোধকে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে আমরা পারবো তাদের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে, হতে পারবো পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ জাতি।
লেখক : কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী