শরীরের ক্ষত শুকিয়েছে হৃদয়ের ক্ষত শুকায়নি: শওকত আলী বীরবিক্রম

শুক্রবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯,৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ
0
124

[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ

এজি লাভলু, স্টাফ রিপোর্টার: বীরমুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্যাগ ও সাহসিকতার জন্য দেশ স্বাধীনের পর বীরবিক্রম উপাধিতে ভুষিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। একাত্তোরের মুক্তিযুদ্ধে ১১নং সেক্টরের অধীনে তিনি কোদালকাটি, চিলমারী, কামারজানি, তারাবরঘাট ও হাতিয়ার সম্মুখ যুদ্ধসহ অনেক গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। উলিপুর হাতিয়ার সম্মুখ যুদ্ধে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এই অকুতোভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম।

টগবগে যুবক ১৯৬৯ সালে বি.কম পাশ করে কর্মের সন্ধান করছিলেন। চিলমারী উপজেলাধীন রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়ারী (হাসেরভিটা) গ্রামের মৃত এজাব উদ্দিন সরকার ও মৃত শরিতন নেছার দ্বিতীয় ছেলে শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম। ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭১ সাল সারাদেশে শুরু হয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন আর বাংলার মাটিকে দখলের যুদ্ধ। মা-বোনদের বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাষবিক অত্যাচার চালাতো পাকিস্তানী নরপশুরা। চারদিক থেকে ভেসে আসত শুধু গোলাগুলির শব্দ। নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি সেই সাহসী যোদ্ধা শওকত আলী। ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা যুদ্ধের যে দিকনির্দেশনা ছিল তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাড়ী থেকে নিজ ইচ্ছায় বের হয়ে যান দেশ মাতৃকার সম্ভ্রম রক্ষার্থে তিনি। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে নিজের মাতৃভুমিকে স্বাধীন করার ইচ্ছা লালন করে নদী পাড় হয়ে রৌমারীতে গিয়ে যুদ্ধে যোগদেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম বলেন, ‘সৈয়দপুরে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্লাটুনের বেশি সেনা রকেট লাঞ্চার, এলএমজিসহ ভারি অস্ত্র নিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী হয়ে নদীপথে রৌমারী চলে আসি। সেখানে সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়া ও নুরুল ইসলাম পাপু মিয়ার তত্ত্বাবধানে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে শুরু হয় যুবকদের প্রশিক্ষণ। এখান থেকে গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারীতে হঠাৎ করে পাক বাহিনীর আগমন সম্ভব না হওয়ায় সেটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের নিরাপদ ঘাটি। পাক বাহিনী ওই নিরাপদ অঞ্চলের খবর জানতে পেরে ট্রেনযোগে চিলমারীতে এসে শক্ত ঘাটি গড়ে তোলে। হানাদার বাহিনীর সেই শক্ত ঘাটি ভাঙতে ১ আগস্ট সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে আমরা চিলমারীর সেই পাক ঘাটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করি এবং প্রতিবাদ গড়ে তুলি। কিন্তু হানাদারদের তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটে তেলিপাড়ার চরে আশ্রয় নেই। সেখান থেকে জানতে পারি বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে গানবোর্ডে পাকবাহিনী আসছে। আমাদের দু’দিক থেকে তারা ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের দৃঢ শক্তির কাছে তারা টিকতে পারেনি। দু’দিন পর পাক সেনারা মোহনগঞ্জে থাকা সহযোগীদের সহায়তায় ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে কোদালকাটিতে অবস্থিত ভেলাবাড়ী স্কুলে অবস্থান নেয়। আলতাফ সুবেদারের নেতৃত্বে আমরা পাক বাহিনীর ক্যাম্পের পাশে একটি নালায় পজিশন নেই এবং রাতে দু’পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে টানা ৭ দিন ধরে তা চলতে থাকে। যা ‘কোদালকাটির যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। গোলাগুলির পর অবশেষে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বহু রক্তাক্ত লাশ দেখি। কিছু লাশ তারা নিয়ে যায়। কিছু বালুতে পুঁতে রাখে। কুকুর সেগুলো নিয়ে টানাহেঁচড়া করছিল। এক ফকির আমাদের জানায়, পাক বাহিনী ৭ দিনে দুই-আড়াইশ’ লাশ নিয়ে যায়। সে যুদ্ধে আমাদের ২১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল। এরপর গেরিলা অপারেশন করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করি আমরা।

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল হাতিয়া অপারেশন। হাতিয়ার সম্মুখ যুদ্ধে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন অকুতোভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম।

সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম বলেন, ১৩ নভেম্বর ভোররাতে পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। আমি ২৫ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে ওদের ওপর আক্রমণ করি। ওরাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। সে যুদ্ধে আমার কয়েকজন সহকর্মী মারাও যান। আমি নিজেও সেদিন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রৌমারীতে প্রাথমিক চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের তেলঢালা চিকিৎসা কেন্দ্রে যাই এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আবার ফিরে আসি। ওই সময়ে হাতিয়ার দাগারকুঠি নামক স্থানে ৬৯৭ জন নিরীহ মানুষকে এক সাথে হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী। শরীরের ক্ষত শুকালেও হৃদয়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি।

শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সেই দিন গুলির স্মৃতিচারন করতে করতে বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে আমরা নিজ হাতে বিশ্বাস ঘাতক রাজাকারদের শাস্তি দিয়েছি। তারপরও যারা (রাজাকার) আমাদের সামনে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করছিল তাদের শাস্তি হওয়ায় সেই দিনগুলির কষ্টকে ভুলে গিয়েছি।

বিঃদ্রঃ মানব সংবাদ সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করুন। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে