প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এবং এর লক্ষণ ও প্রতিকার

মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৮, ২০২০,১০:১৭ পূর্বাহ্ণ
0
235

[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]

কোভিড-১৯ যা করোনাভাইরাস নামে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এই ভাইরাস। সারাবিশ্বে  ছড়িয়ে পড়েছে এই  প্রাণঘাতী ভাইরাস।

করোনাভাইরাস কী এবং কীভাবে ছড়ায়?
করোনা ভাইরাস বলতে এক গোত্রের অনেকগুলো ভাইরাসকে বোঝায়, যা মূলত প্রাণীদের মধ্যে পাওয়া যায়। বার্ড ফ্লু তথা সার্স ভাইরাসও এই গোত্রের।  করোনা ভাইরাস এক ধরনের রোগ এবং এই সংক্রমণটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

অনেক রকম প্রজাতি আছে ভাইরাসটির। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত প্রায় ৬টি করোনা ভাইরাস সনাক্ত করেছেন, যা মানুষকে প্রভাবিত করে এবং হালকা থেকে মারাত্মক লক্ষণ সৃষ্টি করে।

১৯৬০ সালে একজন রোগীর মধ্যে করোনা ভাইরাসের প্রথম খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, যিনি সর্দিতে ভুগছিলেন। এর আকৃতির ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাস নামটি এসেছে। এই ভাইরাসটি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ক্রাউন বা মুকুটের মতো দেখতে হওয়ায় এর নাম হয়েছে ‘করোনা’।

ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯ – এনসিওভি বা নভেল করোনাভাইরাস। এটি এক ধরণের করোনাভাইরাস।  অনেক রকম প্রজাতি আছে করোনাভাইরাসের, কিন্তু মানুষের দেহে এর মধ্যে মাত্র ৬টি প্রজাতি সংক্রমিত হতে পারে। তবে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি নতুন ধরণের এই ভাইরাসের কারণে।

মানুষ প্রায়ই তাদের জীবনের কোনও না কোনও সময়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, সুস্থ হয়ে ওঠে এবং কয়েক মাস পরে আবার সংক্রমিত হতে পারে। ৬ ধরনের করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে মানুষের দেহে, যথা – আলফা করোনা ভাইরাস (NL63 এবং 229E), বিটা করোনা ভাইরাস (HKU1 ও OC43) এবং বাকি দুটি সার্স ও মার্স তাদের প্রাণঘাতী লক্ষণগুলোর জন্য পরিচিত।

সাধারণত একজন ব্যক্তির শ্বাসনালীকে প্রভাবিত করে এই নোভেল করোনা ভাইরাস। কাশি বা হাঁচির সময় এক ব্যক্তির থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে চলে যায় শ্বাসনালীতে সংক্রমিত তরল। এছাড়াও, যদি সংক্রামিত ব্যক্তি মুখ না ঢেকে খোলা বাতাসে হাঁচি বা কাশি দেয়, তাহলে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যান্য কারণ হলো, সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে হাতমেলান,  সংক্রামিত কোনো বস্তুর সাথে নাক বা মুখ একসঙ্গে স্পর্শ করা এবং বিরল ক্ষেত্রে, রোগীর মলমূত্র স্পর্শ করা। নোভেল করোনা ভাইরাসের লক্ষণ NL63 এবং 229E, HKU1 ও OC43-এর কারণে ফ্লু-এর মতো লক্ষণ দেখা দেয় যা, হালকা থেকে মাঝারি আকার ধারণ করে। অন্যদিকে, মার্স ও সার্স মারাত্মক লক্ষণ সৃষ্টি করে।

করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস  যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায় নি।বিজ্ঞানীদের মতে, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিয়েছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে অর্থাৎ মিউটেট করছে। যার ফলে এটি দিনকে দিন আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

ইউনিসেফের মতে, শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ দেখা দিতে পারে । কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

নোভেল করোনাভাইরাস কীভাবে ছড়িয়েছে ?

নোভেল করোনাভাইরাস রোগের সূচনা  মধ্য চীনের উহান শহর থেকে। গত ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে। এর পর ১১ই জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।

বিশেষজ্ঞরা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেন নি ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা।

তবে তারা বলছেন, সম্ভবত কোন প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোন মানুষের দেহে ঢুকেছে, এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে।

সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। মার্স ভাইরাস ছড়ায় উট থেকে। বলা হচ্ছে, এর সাথে উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজারে গিয়েছিল এমন লোকদের সম্পর্ক আছে বলে। ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো।

করোনাভাইরাস বহন করতে পারে কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন বেলুগা জাতীয় তিমি। তবে উহানের ওই বাজারে জ্যান্ত মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, এবং সাপ বিক্রি হতো। হয়তো এগুলোর কোন একটি থেকে এই নতুন ভাইরাস এসে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি এখন চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী মহামারি তাণ্ডব চালাচ্ছে।যার ফলে সারাবিশ্বে এখন পযর্ন্ত ৩০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে ২ লাখের অধিক।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে কী লক্ষণ দেখা যায়?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় পাঁচ দিন লাগে ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে । প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তার পর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন কোন কোন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।

মানুষের মধ্যে যখন ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেবে তখন বেশি মানুষকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে তাদের। তবে এমন ধারণাও করা হচ্ছে যে নিজেরা অসুস্থ না থাকার সময়ও সুস্থ মানুষের দেহে ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে মানুষ।

এই ভাইরাসের পূর্ববর্তী লক্ষণগুলো হলো :
* সর্দি
* গলা ব্যথা
* কাশি

* হাঁচি
* মাথা ব্যাথা
* জ্বর
* অবসাদ
* শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।

এক্ষেত্রে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং যারা বয়স্ক তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে এবং নিউমোনিয়া বা শ্বাস নালীর ব্যাধির মতো মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে।

নির্দিষ্ট কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে নোভেল করোনা ভাইরাস  নির্ণয় করা হয়, যথা – মলিকিউলার টেস্ট : সক্রিয় সংক্রমণের লক্ষণগুলি খুঁজে বের করতে।
সেরোলজি টেস্ট : এই পরীক্ষাটি নজরদারি করার উদ্দেশ্যে। এটি পূর্ববর্তী সংক্রমণ থেকে অ্যান্টিবডিগুলি সনাক্ত করার জন্য করা হয়, যা একজন ব্যক্তির ভাইরাসের ধরন প্রকাশিত করে।

নোভেল করোনাভাইরাস এর সঠিক চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার করা হয়নি। এখনো গবেষণা চলছে বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন নিয়ে। তবে, অনেকগুলো সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ওষুধ রয়েছে যেগুলো এর হালকা থেকে মাঝারি উপসর্গগুলির চিকিৎসা করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, ব্যথা ও জ্বরের চিকিৎসার জন্য ওষুধ বা গলা ব্যথা নিরাময়ের জন্য গরম পানি ইত্যাদি।

নোভেল করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ও এর হাত থেকে রক্ষা পাবার উপায় কী?

যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো নেই, এবং এমন কোন চিকিৎসা নেই যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের লক্ষ্যে। তবে ইউনিসেফ বলছে, সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করে  এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। একমাত্র উপায় হলো, যারা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে বা এ ভাইরাস বহন করছে  তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। তা ছাড়া বার বার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরিধানের মাধ্যমে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।

নোভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কিছু করণীয়
* হাঁচি বা কাশির পরে হাত ধুয়ে নিন।
* কাশি বা হাঁচির আগে মুখ ঢেকে নিন।

* নিজেকে সারাক্ষণ হাইড্রেট রাখুন।
* কারো যদি মনে হয় যে সে সংক্রামিত, তাহলে  ব্যক্তি ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলুন।
* লক্ষণগুলো দেখা দেয়া মাত্রই ওষুধ খান এবং পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠতে দেবেন না।
* ধূমপান করা এড়িয়ে চলুন।

* রান্না না করা গোশত ও ডিম খাওয়া এড়ান।
* যথাযথ বিশ্রাম নিন।
* ভিড় থেকে দূরে থাকুন।

সবাইকে সচেতনভাবে এই চর্চাগুলো করতে হবে। রোগী বা আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রাখতে হবে এবং তার সেবার ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে  সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে রোগ ছড়ানোর সম্ভাব্য পথ বন্ধ করতে হবে।

এছাড়া দ্রুত সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তির পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। যদি করোনা নিশ্চিত হয় তাহলে আইসোলেশনে রেখে তার চিকিৎসা করতে হবে। যাদের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি কিন্তু আক্রান্ত এলাকা থেকে এসেছে বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন তাদেরকে অবশ্যই ১৪ দিন হোম অথবা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন এ রাখতে হবে।

বিঃদ্রঃ মানব সংবাদ সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করুন। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে