[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]
উন্নয়ন ও জনজীবনের গতিশীলতা চরম বিপাকে
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত যে শব্দটি তা হচ্ছে দুর্নীতি। অফিস পাড়া থেকে শুরু করে মহল্লার চায়ের দোকান পর্যন্ত সকলের মুখে মুখে উচ্চারিত শব্দ দুর্নীতি। দেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে দুর্নীতির কালো ছায়া। যার ফলে চরম বিপাকে পড়েছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও জনজীবনের গতিশীলতা।
দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের জানতে হবে দুর্নীতির সংজ্ঞা বা দুর্নীতির ব্যাখ্যা।
সাধারণভাবে দুর্নীতি বলতে মানুষের মনে যে ব্যাখ্যাটি ঘুরপাক খায় তা হচ্ছে, নৈতিকতার স্খলনজনিত কারণে ঘটিত কার্যক্রমে হচ্ছে দুর্নীতি। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে দুর্নীতি হচ্ছে অপ্রীতিকর বা প্রতারণা মূলক আচরণে ক্ষমতার অপব্যবহার। দুর্নীতি দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান , সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশে দুর্নীতি হল দেশটির একটি চলমান সমস্যা, এছাড়াও দেশটি ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় পৃথিবীর তৎকালীন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্থান লাভ করে।২০১১ এবং ২০১২ সালে দেশটি তালিকার অবস্থানে যথাক্রমে ১২০ এবং ১৪৪ তম স্থান লাভ করে, যেখানে কোন দেশ নম্বরের দিক থেকে যত উপরের দিকে যাবে ততই বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ হিসেবে গণ্য হবে। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ।
গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে টিআই-এর দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৮-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সেখানে দেখা যায় ২০১৮ সালের সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩ তম।
সবেচেয়ে বেশি দুর্নীতি হওয়া দেশের তালিকায় টানা পাঁচ বছর শীর্ষ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল ২০১৭ সালে। তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭। এ বছর চারধাপ অবনতি হয়ে ১৩ তম অবস্থানে আসে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শূন্য থেকে ১০ স্কেলে স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই স্কেলে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। পাঁচ বছরে বাংলাদেশে স্কোর ছিল যথাক্রমে ০.৪, ১.২, ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয় (স্কোর-২), ২০০৭ সালে সপ্তম (২), ২০০৮ সালে দশম (২.১), ২০০৯ সালে ১৩তম (২.৪), ২০১০ সালে ১২তম (২.৪), ২০১১ সালে ১৩তম (২.৭)।
২০১২ সাল থেকে নতুন স্কেলে স্কোর নির্ধারণ চালু হয়েছে। বর্তমানে স্কোর নির্ধারণ করা হয় শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে। ২০১২ সালে ১৩তম (২৬), ২০১৩ সালে ১৬তম (২৭), ২০১৪ সালে ১৪তম (২৫), ২০১৫ সালে ১৩তম (২৫), ২০১৬ সালে ১৫তম (২৬), ২০১৭ সালে ১৭তম (২৮) ও সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম (২৬)।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) এর পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দিন দিন বেড়েই চলছে দুর্নীতি। প্রতিটি খাতে প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি হচ্ছে।ভোগবাদী মানসিকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায় ভোগবাদী মানসিকতাই দায়ী। বাংলাদেশে বর্তমানে সব শ্রেণির ব্যাক্তিরাই ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। তবে উচ্চ পর্যায়ের কর্তারা মূলত তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে গিয়ে ঘুষ গ্রহণকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করে। মধ্যবিত্তরা ও নিম্নবিত্তরাও তাদের জীবনযাত্রা মান উন্নয়নে ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। দেখা যায় যে প্রতি ক্ষেত্রেই মানুষ ঘুষ খেয়ে থাকে।
দেশের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে প্রশাসন, উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী হতে সাধারণ ব্যবসায়ী সকলেই দুর্নীতিতে জড়িত। এমনকি দুর্নীতি নিরসনে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা দুদক পরিচালককে নিয়েও সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি সমস্ত দেশবাসীর নিকট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে । প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ সুবিধা প্রদানের পরও তাদের এই দুর্নীতির কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ করছে দেশের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনাকে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী মহল, চিকিৎসা খাত, শিক্ষা খাত, শিল্পখাত, বিদ্যুৎখাত এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দৃশ্যমান।
দুর্নীতির অভিযোগ গুলোর মধ্যে বিশেষভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাত। দূর্নীতি শুধু এই বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের অসাধু কিছু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা ভোগের জন্য দুর্নীতি করে যাচ্ছে মানুষের জীবনের সাথে। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ, নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন ও পণ্য সরবরাহ, মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রয় সহ আরো অনেক নিগৃহীত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে যা দুর্নীতির শামিল। দেশের পত্রপত্রিকা, সংবাদ মাধ্যম, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি সরকার কর্তৃক পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালতের রিপোর্ট অনুযায়ী এর সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে। গেল রমজান মাসে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানে এইসব ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়েছে এবং দোষীদের জরিমানা ও শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
দেশের সাধারন জনগনের সাথে সাথে বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করেন যে, শুধু শাস্তি ও জরিমানা বিধান করে এর যথাযথ সমাধান করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য করা যায় যে, দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বরখাস্ত বা পদ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। ফলে শাস্তি প্রদান করা হলেও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না দুর্নীতি। চলমান বিধান থেকে সরে এসে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণই কেবলমাত্র পারে দুর্নীতি রোধ করতে। দূর্নীতিকারী যেই হোক না কেন তাকে পদচুত্য করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হবে এমনটাই মনে করেন জনসাধারণ।
সরকারের আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও আইন প্রণয়ন করা উচিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। যারা দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, দেশের মানুষ সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করে সেই সকল স্বার্থ লোভী মানুষগুলোর।
উচ্চ আদালত ও সরকার প্রধানের নিকট বিশেষ অনুরোধ, যেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ও তাদের কার্যক্রম চলমান থাকে। যেন কোনোভাবেই পার না পায় এই দুর্নীতিবাজরা। যথাযথ ও কার্যকরী ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে।
দেশের সরকারের সাথে এক হয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে শামিল হয়ে নিজেদেরকে সচেতন হয়ে এই দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত ও প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মানের গতিশীলতা নিশ্চিতকরণে এখনই সময় সকলকে সোচ্চার হয়ে উঠতে হবে এই দুর্নীতিবাজ অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে। তা না হলে অচিড়েই দেশে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।
লেখক: শাহরিয়ার আহমেদ
নির্বাহী সম্পাদক, মানব সংবাদ।