[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]
বিবেকহীনতা, বুদ্ধিহীনতা, যাচাইহীনতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ও ব্যাহত করছে সামগ্রিক উন্নয়ন
একটা সময় গ্রামবাংলায় বহুল প্রচলিত একটি কথা ব্যবহার করা হতো। কথাটি হচ্ছে অনেকটা এরকম যে, ‘চিলে কান নিয়ে গেছে বলে চিলের পিছন পিছন দৌড়ানো।’ আদৌতে কানটি ঠিক জায়গায় আছে কিনা, কিংবা সত্যিই চিলে নিয়ে গেল কিনা তা যাচাই না করেই চিলের থেকে কান উদ্ধার করার জন্য মরিয়া হয়ে ছুটছে সবাই।
বর্তমানে দেশে এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজমান। ঠিক চিলে কান নেওয়ার মতোই মানুষ গুজবের পিছনে মরিয়া হয়ে ছুটছে। ভুল সঠিক বিচার বিবেচনা না করেই শোনা কথায় কান দিয়ে সেই কথার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে।
একটি ঘটনা সত্যি নাকি মিথ্যা তা যাচাই না করেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করা এবং তা জনসাধারণের নিকট ছড়ানো এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করাই হচ্ছে গুজব। যা দেশের চলমান স্থিতিশীল অবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে। গুজব যে শুধু দেশের চলমান পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করছে তাই নয় বরং একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নসহ অর্থনীতি ও জনজীবনে মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা ফেলছে। যার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগা, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণপিটুনি, ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি, পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং সর্বশেষ লবণের যথাযথ ও পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও এই নিয়ে গুজবের সৃষ্টির ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যার ফলশ্রুতিতে গেল কয়েক মাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ব্যাপক মাত্রায় অস্থিতিশীল অবস্থায় বিরাজ করছে।
একটি কুচক্রী মহল সর্বদায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য। সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করা এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে অন্য পথে চালিত করে এই অরাজকতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে তারা। খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে তারা দেশের চলমান গতিশীলতাকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
সম্প্রতি পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে চলমান অস্থিরতা কাটতে না কাটতেই দেশের বাজারে ‘লবণের ব্যাপক সংকট’ এই মর্মে একটি গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানো হয়েছে। যার ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লবণের দাম কেজিপ্রতি ১৫০ টাকা থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার ফলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ অধিক মূল্য প্রদান করেও লবণ কিনেছে। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে সে অসাধু কুচক্রীমহল।
গত ২২ মে ২০১৯ এ ‘মানব সংবাদ‘ সহ দেশের বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য জাতীয় পত্রিকায় “চাহিদার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে দেশে” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটি একটি উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার ও গুজব ব্যতীত আর কিছুই না।
লবণ নিয়ে এই অপপ্রচার মূহুর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মুঠোফোন সেবার মাধ্যমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে সাধারণ জনমনে।ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারগুলোতে অস্থিতিশীল পরিবেশ প্রতীয়মান হয়।
দেশের মানুষ এই গুজবের শিকার হচ্ছে। একটির পর একটি গুজব সৃষ্টি এবং তা জনমনে প্রভাব ফেলা এবং জনগণ সেই গুজবটি আগ্রহের সাথে গ্রহণ করার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করছে বিবেক, বুদ্ধিমত্তা, যাচাই ও বিশ্লেষণধর্মী মনোভাবকে এবং একইসাথে দেশের ভাবমূর্তি ও উন্নয়নকে। কোন প্রকার যাচাই-বাছাই না করে নিজের বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান-দক্ষতা প্রয়োগ না করেই গুজবে সাড়া দেয়া একজন স্বাধীন দেশের নাগরিকের পক্ষে কতটা যুক্তিযুক্ত? এ প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের জানা আছে?
আমরা কি একবারও চিন্তা করেছি এই বিষয়গুলো নিয়ে।২০১৯ সালের শেষদিকে এসেও আমাদের এমন বিবেকহীন কর্মকাণ্ড সত্যিই নতুন ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। যা একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির জন্য নিঃসন্দেহে হতাশার বিষয়।
যে দেশ তাদের বিবেক ও বুদ্ধিমত্তার কারণে সারাবিশ্বে সমাদৃত ও সম্মান অর্জন করে নিজেদেরকে বিশ্বের অন্যতম ত্যাগী, দৃঢ় বিশ্বাসী ও বীরের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই দেশের জনগণের জন্য এই সকল বিবেক-বুদ্ধিহীনতা ও যাচাই-বাছাইহীনমূলক মনোভাব কি আদৌ মানায়?
তবে সরকারের নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের উপর এই গুজব বা অপপ্রচার মোকাবেলায় দায়িত্ব বর্তায়। যদিও কর্তৃপক্ষ এই গুজব প্রতিরোধে কিছু দায়িত্ব ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা এই গুজব একেবারে নির্মূল, প্রতিহত তথা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে সমর্থ নয়। দেশের সচেতন নাগরিক বিশ্বাস করেন কোন অপশক্তিই একটি দেশের সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশীল হতে পারে না। কাজেই সরকারের উচিত অন্যান্য অভিযানের মত এই গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা ও দেশের চলমান উন্নয়নের গতিশীলতা বজায় রাখতে এবং দেশের জনগণকে এই মগজ ধোলাইয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যত দ্রুত সম্ভব গ্রহণ করা।
আর সরকারের পাশাপাশি দেশের সকল নাগরিকের উচিত এই গুজব প্রতিহত করা। অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি খবর পেয়েই যেন চিলে কান নিয়ে যাওয়ার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না করা। যেকোন তথ্য,খবর, সংবাদ অনলাইনে ছড়ানোর আগে নিজের অর্জিত জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, দক্ষতা ইত্যাদির প্রয়োগ করে সত্য-মিথ্যা উদঘাটনের পর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, গুজব যে শুধু অপপ্রচার চালাচ্ছে তা নয়, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাসহ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। দিনশেষে যার মাশুল গুনতে হবে স্বাধীন বাঙালি হিসেবে নিজেকেই।
এই নিবন্ধের লেখকঃ শাহরিয়ার আহমদ, নির্বাহী সম্পাদক, মানব সংবাদ।