কক্সবাজার ভ্রমণে প্রয়োজনীয় ও করণীয় বিষয়সমূহ

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯,৪:০০ অপরাহ্ণ
0
1742

[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]

বিভিন্ন ছুটি ও কর্মাবসরে আমরা অনেকেই অনেক জায়গায় ঘুরতে যাই। আর তা যদি হয় কক্সবাজারে, তাহলেতো আর কথাই হয় না। তাই আজ কক্সবাজার ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। 

কক্সবাজার
সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে বিশাল সমুদ্র। নীল জলরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকতের নাম কক্সবাজার। অপরূপ সুন্দর বিশ্বের বৃহত্তম এই সমুদ্র সৈকতে যারা সপরিবারে বেড়াতে চান তাদের জন্যই এই আয়োজন।

নামকরণ ও ইতিহাস
কক্সবাজার নামকরণের পেছনে রয়েছে ছোট্ট একটা ইতিহাস। এর প্রাচীন নাম ছিল পালংকী। একসময় এটি প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল। প্যানোয়া শব্দটির অর্থ ‘হলুদ ফুল’। অতীতে কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এই হলুদ ফুলে ঝকমক করত। স্থানীয় বাসিন্দারা এই সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য সম্পর্কে ছিলেন উদাসীন। ব্রিটিশ শাসনামলে একজন ইংরেজ সৈনিক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স অষ্টাদশ শতকে পালতোলা কাঠের জাহাজে করে এখানে এসে নামেন। ১৭৯৯ সালে তিনি এখানে একটি বাজার স্থাপন করেন। পরবর্তীতে হিরাম কক্সের নামানুসারেই এলাকাটির নামকরণ করা হয় কক্সবাজার নামে।

অবস্থান
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গপোসাগরের পূর্ব উপকূলে কক্সবাজার জেলা শহরের অবস্থান। উত্তরে হারবাং-এর সুউচ্চ পাহাড় থেকে দক্ষিণে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে নাফ নদীর কোল ঘেঁষে সাবরং এর শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত এর অবস্থান। জেলাটির আয়তন ১৩৯১.৮৫ বর্গ কিলোমিটার। লোক সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। বঙ্গপোসাগরের বুকে অবস্থিত মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কক্সবাজারে রয়েছে দর্শনীয় বেশ কয়েকটি স্থান। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মাতার বাড়ি, শাহপরী, সেন্টমার্টিন কক্সবাজারকে করেছে আরো আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে মাতা মুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কুহেলিয়অ ও নাফ নদী। পর্যটন, বনজসম্পদ, মৎস্য, শুটকিমাছ, শামুক, ঝিনুক ও সিলিকাসমৃদ্ধ বালুর জন্য কক্সবাজারের অবস্থান তাই ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কাছে সবার শীর্ষে। সমুদ্রতটের অপার সম্ভাবনাময় এ দ্বীপখণ্ড তাই সমৃদ্ধির আশায় ছুটে এসেছে মগ, পর্তুগিজ, আরব, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজরা। কালের বিবর্তনে এখানে লেগেছে উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ছোঁয়া। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কক্সবাজারকে মহকুমায় উন্নীত করেন। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ কক্সবাজারকে পূর্ণাঙ্গ জেলায় রূপান্তরিত করা হয়। ২০০২ সালে আটটি উপজেলা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কক্সবাজার সদর, রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া ও টেশনাফ।

সতর্কতা ও সঙ্গে যা নিবেন
* কতদিন, কোথায় কোথায় থাকবেন, বেড়াবেন তার পূর্ণাঙ্গ গাইড ও তথ্য জেনে নিন।
* যাত্রার পূর্বে রেইন কোট, ছাতা সঙ্গে রাখুন।
* টর্চ, ব্যাটারি মোমবাতি, ম্যাচ, পানির বোতল, পানি বিশুদ্ধ করা ট্যাবলেট, টুপি, হাফপ্যান্ট, ট্রাউজার, সানগ্লাস সঙ্গে রাখুন।
* আগেই পরিবহন ও যাতায়াতের ব্যবস্থাসহ বাসস্থানের পরিপূর্ণ ঠিকানা ফোন নম্বর ও মোবাইল নম্বর জেনে নিন।
* খাবার হোটেল, হাসপাতাল, পুলিশ, সেলুনের অবস্থান জেনে নিন।
* সঙ্গে রাখুন ফিল্ম, ব্যাটারি, ক্যামেরা ও বাইনোকুলার।
* নোটবুক, কলম ও ছোট হ্যান্ডব্যাগ, মানিব্যাগ, মোবাইল সযত্নে রাখুন।
* জেনে নিন খাবার মেন্যু, থাকার ভাড়া সম্পর্কে। এছাড়া পরিবহন খরচের ব্যাপারে আগেই স্বচ্ছ ধারণা নিন।
* নিরাপত্তার জন্য হোটেলের ভিজিটিং কার্ড, মোবাইল নম্বর ছাড়াও স্থানীয় পুলিশ ও বিচ পুলিশ ফাঁড়ির ফোন ও ইয়াছির লাইফ গার্ডের নম্বরসমূহ সঙ্গে রাখুন। কোনো রকম বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলেই হোটেল কর্তৃপক্ষ ও কর্তব্যরত পুলিশের সহায়তা নিন।
* কেনাকাটায় সতর্ক থাকুন। আগেই গাড়ির সিট বুক করে রাখুন।
* বিচের উঁচু নিচু এলাকা সম্পর্কে সতর্ক হোন। প্রয়োজনে ভাটার সময় গিয়ে বিচের উঁচু নিচু এলাকা দেখে আসুন। কেননা জোয়ারের সময় এসব এলাকা পানিতে পরিপূর্ণ থাকে।
* ভাটার টানে নিচু এলাকায় পড়ে অনেকে তীরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হন। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে ইয়াছির লাইফ গার্ডসহ স্থানীয়দের পরামর্শ মেনে চলুন।
* একাকী ভ্রমণের চেয়ে দলগতভাবে ভ্রমণ বেশ আনন্দদায়ক। এক্ষেত্রে দলের সঙ্গে থাকুন। বিচ্ছিন্ন হয়ে চলাচল না করাই উত্তম। এতে খরচও বেশি হয়।
* প্যাকেজ ট্যুরের ব্যাপারে ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে বিস্তারিত জেনে নিয়ে তবেই বুকিং দিন। কোনো সমস্যা দেখা দিলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এদের অফিসের মোবাইল ও গাইডের নম্বর সংরক্ষণ করুন। ঢাকা থেকে ৪১৪ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারের অবস্থান।
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার যেতে হয়। পাশাপাশি ঢাকা থেকে প্লেনেও চট্টগ্রাম নেমে বাসে বা মাইক্রোতে কক্সবাজার পৌঁছানো যায়। এখানে থাকার জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিকমানের পাঁচতারা সুবিধাসম্পন্ন হোটেল ছাড়াও ছোট-বড় অনেক মোটেল, রেস্ট হাউস বা বোর্ডিং। শীত মৌসুমে যারা কক্সবাজার ভ্রমণে যেত চান তাদের আগেভাগেই হোটেলের সিট বুক করা ভালো। দুভাবে হোটেল বুক করা যায়। প্রথম সরাসরি গিয়ে কিংবা আগে ফোনে যোগাযোগ করে তারিখ জানিয়ে কুরিয়ারে টাকা পাঠিয়ে। এসএ পরিবহন ছাড়াও কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিসে,বিকাশে,ব্যাংকে টাকা পাঠানো যায়।

বিচ ফটোগ্রাফি
কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে ২৫০-৩০০ বিচ ফটোগ্রাফার পর্যটকদের ছবি তুলে থাকে। প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই এসব ছবি প্রিন্ট করে নেগেটিভসহ পর্যটকদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা রয়েছে। লাল পোশাক পরা এসব বিচ ফটোগ্রাফারদের প্রত্যেকের রয়েছে একটি করে আইডি কার্ড। বেশ কয়েকটি স্টুডিও এ কাজের সঙ্গে জড়িত। সরকারি রেট সর্ম্পকে জেনে নিন। এ সম্পর্কিত সাইনবোর্ড মেইন বিচে দেখতে পাওয়া যায়। এসব বিচ ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকে ছবি তোলার আগে আইডি কার্ড দেখে নেওয়া ভালো।

স্পিডবোট
বিচে চলে বেশ কয়েকটি স্পিডবোট। মেইন বিচ থেকে এগুলো চলাচল করে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত। ভাড়া এক রাউন্ড ৫০ টাকা। এছাড়া খোলা স্পিডবোটের সাহায্যে চলে লাইফ বোট জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা।(ভাড়া পরির্বতন যোগ্য)

সমুদ্রে নামার আগে সতর্কতা
সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই জোয়ার-ভাটার সময় জেনে নিন। এ সম্পর্কিত ইয়াছির লাইফ গার্ডের বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড ও পতাকা রয়েছে বিচের বিভিন্ন স্থানে। জোয়ারের সময় সমুদ্রে গোসলে নামা নিরাপদ। এ সময় তাই জোয়ারের সময় নির্দেশিত থাকে, পাশাপাশি সবুজ পতাকা ওড়ানো হয়। ভাটার সময়ে সমুদ্রে স্নান বিপজ্জনক ভাটার টানে মুহূর্তেই হারিয়ে যেতে পারে যে কেউ। তাই এ সময় বিচ এলাকায় ভাটার সময় লেখাসহ লাল পতাকা ওড়ানো থাকলে সমুদ্রে নামা থেকে বিরত থাকুন। কোনোভাবেই দূরে যাবেন না। প্রয়োজেন পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইয়াছির লাইফ গার্ডের সহায়তা নিন। ওদের জানিয়ে বিচে নামুন।

বিচ বাইক
তিন চাকার বেশ কয়েকটি বিচে চলার উপযোগী বাইক কক্সবাজার সাগর সৈকতে চলাচল করে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্বে এসব বাইক রাউন্ড প্রতি ৭০ টাকা করে পর্যটকদের প্রদান করতে হয়।

যাতায়াত ও ভাড়া
যারা ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যেতে চান তারা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার অথবা সরাসির বাসে কক্সবাজারে যেতে পারে। ঢাকার ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিলসহ বেশ কয়েকটি স্থানে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। এসি ও নন এসি, ডিলাক্স ও সাধারণ এসব সরাসরি বাস পরিবহনের ভাড়া পড়বে ৭০০-২২০০ টাকা পর্যন্ত। সোহাগ,দেশ ট্রাভেলস, গ্রীন লাইন ছাড়াও ঈগল ও অন্যান্য পরিবহনের বাস চলাচল করে। এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কক্সবাজারে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ট্রেন বা বাস ছেড়ে যায়। তবে টিকেট বুকিং আগেভাগেই করে রাখা ভালো। 

কক্সবাজারের আবাসিক ব্যবস্থা 
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও দর্শনীয় বিচ কক্সবাজারে রয়েছে আন্তর্জাতিকমানের বেশ কয়েকটি হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। এছাড়া সরকারি ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ছোটখাটো মানের বেশ কিছু রিসোর্ট, হোটেল ও বোর্ডিং হাউস।হোটেল সিগাল, হোটেল শৈবাল,হোটেল লাবণী,হোটেল উপলে,ইকরা বিচ হোটেল,হোটেল সি ক্রাউন, জিয়া গেস্ট ইন, সুগন্ধা গেস্ট হাউস। এছাড়া অন্যান্য হোটেল রেস্টহাউসের ভাড়া প্রায়ই নির্ধারিত। তবে কক্সবাজার ভ্রমণের পূর্বে ফোনে যোগাযোগ করে বুকিংমানি পাঠিয়ে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ভালো। সরাসরি গিয়েও কথা বলে রুম ভাড়া নেওয়া যায়।

খাওয়া-দাওয়া ও রেস্টুরেন্ট
প্রায় প্রতিটি আবাসিক হোটেল বা হোটেলের সন্নিকটে রেস্টুরেন্ট বা খাবার হোটেল রয়েছে। কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ থাকে সাগরের বিভিন্ন মাছের মেন্যুর প্রতি। বিশেষ করে চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাইট্যা, ছুরি মাছসহ মজাদার শুটকি মাছের ভর্তার প্রতিই পর্যটকদের আকর্ষণ বেশি থাকে। খাবারের মেন্যু অনুযায়ী একে রেস্টুরেন্টে একেক ধরনের মূল্য তালিকা দেখা যায়। তবে বর্তমানে সরকার নির্ধারিত কিছু কিছু তালিকা ভোজন রসিকদের আশ্বস্ত করেছে। মোটামুটি ৬০-৫০০ টাকার মধ্যে সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী মজাদার খাবার গ্রহণ করতে পারবেন। তবে খাবার গ্রহণের পূর্বে খাবারের নাম, মূল্য এবং তৈরির সময় সম্পর্কে জেনে নিন। প্রয়োজনে খাদ্যের তালিকা ও মূল্য টুকে রাখুন। বিলের সঙ্গে মিলিয়ে বিল প্রদান করুন।

এই নিবন্ধের লেখকঃ মনির হোসেন

বিঃদ্রঃ মানব সংবাদ সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করুন। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে