ইসলামে পরধর্ম সহিষ্ণুতা

বুধবার, নভেম্বর ২, ২০২২,৯:৫২ অপরাহ্ণ
0
218

[ + ফন্ট সাইজ বড় করুন ] /[ - ফন্ট সাইজ ছোট করুন ]

সৈয়দ গোলাম মুরসালিন

আল্লাহপাক কোরআনুল মজিদে ঘোষণা করেন : “ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নেই” (সুরা বাকারা : আয়াত ২৫৬)। এবং “তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য” (সুরা কাফিরুন : আয়াত ০৫)। আল্লাহপাক আরো বলেন “হে ঈমানদারগণ ! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে সব দেব দেবীর পুজা করে তোমরা তাদের গালি দিওনা, যাতে করে তারা শিরকে থেকে বাড়িয়ে অজ্ঞতাবশত: আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে” (সুরা আন আ’ম : আয়াত ১০৮)।

ইতিহাস বলে ইসলামের হযরত নবী করীম সা: আ: এর আপনজনদের অনেকেই শুধু ইসলাম বিরোধীই না বরং ইসলামের কট্টর দুশমন ছিল। তথাপি হযরত নবী করীম সা: আ: তাদের প্রতি নির্যাতন এমনকি প্রতিবাদও করেননি। ইসলামে নবী হযরত মুহাম্মদ সা: আ: বলেছেন, “যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে এবং জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয় (সুমানে আবু দাউদ : ৫১২৩)। হযরত রাসুল করীম সা: আ: বলেছেন, “কোন মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা জুলুম করে তবে কেয়ামতের দিন আমি ওই মুসলমানের বিরূদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব।
(আবু দাউদ : ৩০৫২)। হযরত রাসুল করীম সা: আ: বলেছেন, “যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধের পরে কোন মন্দির গীর্জা-উপসনালয় ভেঙ্গে ফেলবেনা (মুসান্নাদ আবী শায়বা : ৩৩৮০৪)।

কোরআনুল করীমে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন “আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সমাচার ও ইনসাফের ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্ম ভিত্তিক যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয়নি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। (সুরা আল মেতহিনা : আয়াত ৮)। হযরত রাসুল করীম সা: আ: বলেছেন: “অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রান পাওয়ার কথা (সহি বুখারি : ৩১৮৬)। খোলাফায়ে রাশেদীনের নিয়ম ছিল, যখন কোন সেনাবাহিনী প্রেরণ করার প্রয়োজন হত তারা অন্যান্য উপদেশের পাশাপাশি এই উপদেশটি অবশ্যই করতেন যে, “যুদ্ধকালীন সময়ে বা যুদ্ধের পর কোন মন্দির-গীর্জা-উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলবেনা” (মুসান্নাফ আবী শাবা : ৩৩৮০৪)।

বিশ্ব মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ সা: আ: অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদীনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল একটি মৌলিক অধিকার সম্পন্ন। তাঁর প্রদর্শিত জীবন ব্যবস্থার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, প্রাচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অন্ধকার পৃথিবীকে তা দিল আলো ও স্বস্তি। … … শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্দুরা তা অধ্যয়ন করুক। তা হলে আমার মতোই তারা একে অপরকে ভালবাসবে।

স্পেনে মুসলিমরা প্রায় একশত বছর শাসন করেছিল, এসময় এখানে শত শত বছর ধরে অমুসলিমদের অবস্থান তাদের প্রতি মুসলমানদের সহনশীলতার প্রমাণ বহন করে।
অর্ধবিশ্বের খলীফা হিসাবে ইতিহাসের পাতায় যিনি প্রশংসিত, ইসলামের কঠোরতম নীতি পরায়ণ খলিফা হযরত উমর ফারুক রা: আ:’র খেলাফতকালে মিশরের শাসন কর্তা ছিলেন হযরত আমর ইবনুল আস রা: আ:। সে সময়ে একদিন আলেজান্দ্রিয়ার খ্রিষ্টান পল্লীতে কেউ যিশু খ্রিষ্টের পাথর নির্মিত মুর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলেছে এবং এ নিয়ে খ্রিষ্টানগণ মুসলমানদের দিকে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করে উত্তেজিত হয়ে উঠল। হযরত আমর ইবনুল আস এর কাছে বিচার এলে তিনি ক্ষতিপুরণ স্বরূপ যা কিছু প্রস্তাব করলেন খ্রিষ্টানগণ তা মেনে না নিয়ে হযরত মুহাম্মদ সা: আ: এর মুর্তি তৈরী করে তার নাক ভেঙ্গে দিবার প্রস্তাব করল। এ প্রস্তাব মেনে নিবার কোন প্রশ্নই আসেনা, হযরত আমর তখন বললেন : এ দেশ শাসন করার দায়িত্ব আমার। আপনাদের ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্বও আমার। আপনারা আমার নাক কেটে নিয়ে এ অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করুন। পরবর্তিতে যে মুসলিম যুবকের অসতর্ক আঘাতের ফলে যীশু খ্রিষ্টের মুর্তির নাক ভেঙ্গে ছিল সে আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু খ্রিষ্টানরা হযরত আমরের এ অন্তহীন মানবিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেল, বিশপ এসে পরম শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে হযরত আমরের সামনে দাঁড়িয়ে ইসলামের মহত্ব ও মানবিকতার প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠে।

হযরত মাওলা আলী রাঃ’র খেলাফতকালে জনৈক মুসলিম কর্তৃক একজন অমুসলিম জিম্মি নিহত হলে হযরত আলী রাঃ আঃ আততায়ী মুসলিমের প্রাণদন্ডের আদেশ দান করেন।
উপরোক্ত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রমাণ করে যে ইসলাম অন্য ধর্মালম্বীদের জীবনযাত্রা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছে।

এ নিবন্ধ শেষ করার আগে আমি চিশতীনগরের মহান প্রতিষ্ঠাতা হযরত কোতবুল আলম শামপুরী (রা:)’র পবিত্র জীবনের একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা উল্লেখ করছিঃ
পন্ডিতসার গ্রামে বর্তমান চিশতীনগরের বাড়ীটি একসময় হিন্দু ভদ্রলোকদের ছিল, হযরত শামপুরী ক্বেবলা তাদের কাছ থেকে বাড়ীটি ক্রয় করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর ক্রয় করা সে বাড়ীতে একটি অতি পুরাতন জরাজীর্ণ ফাটল ধরা কালি মন্দির ছিল। মন্দিরটির অবস্থা এরকম ছিল যে সেটা না ভেঙ্গে আর কোন কিছু করার উপায় ছিলনা। হযরত শামপুরী লোক মারফত স্থানীয় গণ্যমান্য হিন্দু ভদ্রলোকদের কাছে এ ব্যাপারে সংবাদ পাঠিয়ে জানালেন যে এ অবস্থায় আর কোন উপায় না থাকায় তিনি জরাজীর্ণ মন্দির ঘরটি ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবাক বিস্ময় নিয়ে হিন্দু ভদ্রলোকদের অনেকে এসে হযরত শামপুরীকে বললেন, “এ বাড়ীটি আপনি ক্রয় করেছেন, সেখানে বহু পুরাতন, জরাজীর্ণ ফাটল ধরা একটা মন্দিরগৃহ আপনি ভাংবেন, তার জন্য আমাদের জানানোর কি প্রয়োজন ছিল? হযরত শামপুরী তখন তাদের উত্তর করলেন, “আমি জরাজীর্ন মন্দির গৃহটি ভাঙ্গবো, কিন্তু আপনাদের অন্তর ভাঙ্গবোনা কখনোই। তাই আগে আপনাদের জানিয়ে নিলাম।”

বিঃদ্রঃ মানব সংবাদ সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করুন। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে